তাপহারী বিক্রিয়া কাকে বলে? তাপহারী ও তপোৎপাদী বিক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য?
রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাপের পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে বিক্রিয়াকে ২ ভাগে ভাগ করা করা যায় - তাপোৎপাদী ও তাপহারী। এই পোষ্টে আমি তাপহারী বিক্রিয়া কাকে বলে?, তাপহারী বিক্রিয়া চেনার সহজ উপায়, তাপহারী বিক্রিয়ার গ্রাফ বা লেখচিত্র, তাপহারী বিক্রিয়ায় তাপ ও ঘনমাত্রার প্রভাব, বিক্রিয়া তাপ নির্ণয় ইত্যাদি উদাহরণ সহ দেখানোর চেষ্টা করেছি। সেই সাথে তাপোৎপাদী ও তাপহারী বিক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য গুলো ছক আাকারে দেখানো হলো।
তাপহারী বিক্রিয়ায় কাকে বলে?
তাপহারী বিক্রিয়া (Endothermic Reaction):যে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিক্রিয়ক থেকে উৎপাদ উৎপন্ন হওয়ার সময় তাপশক্তি শোষিত হয়, তাকে তাপহারী বিক্রিয়া বলে। অন্যভাবে, যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে তাপের শোষণ ঘটে, তাকে তাপহারী বিক্রিয়া বলে। উদাহরণ:$${H}_2O(s) + \text{Heat} \rightarrow \text{H}_2O(l)$$
(বরফ গলনের সময় তাপ শোষিত হয়।) তাপহারী বিক্রিয়া এমন একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়া যেখানে বিক্রিয়ার সময় পরিবেশ থেকে তাপ শোষিত হয়। এর ফলে বিক্রিয়ার পরিবেশ ঠান্ডা অনুভূত হয়। তাপহারী বিক্রিয়ায় উৎপাদের শক্তি, বিক্রিয়ক পদার্থগুলির শক্তির তুলনায় বেশি থাকে। উদাহরণস্বরূপ, বরফের গলন, বাষ্পীভবন, এবং সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াগুলি বিক্রিয়ার পরিবেশ হতে তাপ শোষণ করে। নিচে উদাহরণ সহ এগুলো আরো বিস্তারিত ব্যাখা করা হলো।তাপহারী বিক্রিয়ায় উদাহরণ
তাপহারী বিক্রিয়া সম্পর্কে আরও জানার আগে দেখে নেওয়া যাক কয়েকটি তাপহারী বিক্রিয়ার উদাহরণ-- সালোকসংশ্লেষণঃ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া একটি তাপহারী বিক্রিয়ার উদাহরণ। এর রাসায়নিক রূপ-
$$6 \text{CO}_2 + 6 \text{H}_2\text{O} + \text{light energy (heat)} \rightarrow \text{C}_6\text{H}_{12}\text{O}_6 + 6 \text{O}_2$$
উদ্ভিদের পাতায় সূর্যালোকের উপস্থিতিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও পানি একত্রে গ্লুকোজ এবং অক্সিজেন উৎপন্ন করে। এ প্রক্রিয়ায় সূর্যালোক তাপশক্তি হিসেবে শোষিত হয়। (এজন্য ছায়া দেওয়া ছাড়াও ফটোসিন্থেসিস প্রক্রিয়ায় গাছ আমাদের পরিবেশের তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে)। -
অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট লবণের দ্রবনঃ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট পানিতে দ্রবীভূত হওয়ার সময় তাপ শোষণ করে তাই এটিও একটি তাপহারী বিক্রিয়া-
$$NH_4NO_3 (s) + \text{Water} \rightarrow NH_4^+ (aq) + NO_3^- (aq)$$
অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সহ বেশ কিছু লবণ তাপহারী বিক্রিয়া দেয়। আবার ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড সহ কিছু লবণ তাপোৎপাদী বিক্রিয়া দেয়, ডি-আইসিং এজেন্ট বা বরফ গলানোর কাজে এদের ব্যবহার করা হয়। -
ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের ভাঙ্গনঃ ক্যালসিয়াম কার্বোনেটে তাপ প্রদান করে ক্যালসিয়াম অক্সাইড ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড পাওয়া যায়, যা একটি তাপহারী বিক্রিয়া-
$$CaCO_3 (s) \xrightarrow{\text{Heat}} CaO (s) + CO_2 (g)$$
এভাবে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট থেকে চুন পাওয়া সম্ভব।
তাপহারী বিক্রিয়ায় তাপের পরিবর্তন
যেহেতু তাপহারী বিক্রিয়ায় উৎপাদ তৈরি হতে তাপ শক্তি পরিবেশ থেকে সিস্টেমে প্রবাহিত হয়, সেহেতু সিস্টেমের মোট তাপ শক্তির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে সিস্টেমের এনথালপি বৃদ্ধি পায়। আর আমরা জানি সিস্টেমের এনথালপি বৃদ্ধি পেলে এনথালপি পরিবর্তনের চিহ্ন ∆H পজিটিভ বা ধনাত্মক হয়। অর্থাৎ ∆H > 0 হয়। গাণিতিকভাবে-$$\Delta H = H_{\text{products}} - H_{\text{reactants}}$$
অন্যদিকে, সিস্টেমে তাপ শোষণ হওয়ায় সিস্টেমের পরিবেশের তাপমাত্রা কম অনূভূত হবে। এখানে প্রায়শই "সিস্টেম" শব্দটি উল্লেখ করেছি আমি, সিস্টেম হলো মূলত বিক্রিয়ার ধারক বা যে মাধ্যমে বিক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছে।তাপহারী বিক্রিয়ায় তাপের প্রভাব
তাপহারী বিক্রিয়া সংঘটনের তাপের ভূমিকা অপরিহার্য। পর্যাপ্ত তাপ সরবরাহ না করা হলে বিক্রিয়া সম্পন্ন হবে না। এটি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাপগতিবিদ্যার লা-শাতেলীয়ারের নীতি মেনে চলে, তাই তাপমাত্রা বৃদ্ধি করলে বিক্রিয়া উৎপাদের দিকে অগ্রসর হয়। অর্থাৎ সিস্টেমে তাপ সরবরাহ বাড়ালে বিক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হয়। অন্যদিকে, সিস্টেমে তাপ সরবরাহ কমালে বিক্রিয়ার গতি হ্রাস পেতে পারে বা পর্যাপ্ত তাপের অভাবে বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এখন একটা প্রশ্ন মনে আসতে পারে, রাসায়নিক বিক্রিয়ার তাপ শোষণ বা উৎপাদন হয় কি জন্য? বা কিভাবে? রাসায়নিক বিক্রিয়ার বিক্রিয়ক যখন উৎপাদ পরিণত হয়, তখন বিক্রিয়ায় দুটো ঘটনা ঘটে। বিক্রিয়ক এর বন্ধনগুলোর ভাঙ্গন, এবং উৎপাদ তৈরি করতে নতুন বন্ধন গঠন। এই বন্ধন গুলো ভাঙ্গতে বাহির থেকে শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। আবার নতুন বন্ধন গড়ার ফলে তাপশক্তি নির্গত হয়। এখন এই বন্ধন ভাঙতে প্রয়োজনীয় শক্তি যদি বন্ধন গঠনের ফলে নির্গত শক্তি থেকে বেশি হয়, তবে বিক্রিয়ার এনথালপি ∆H ধনাত্মক তথা বিক্রিয়ায় তাপের শোষণ ঘটে। এ ব্যাপারে আমরা বিক্রিয়ার তাপ নির্ণয় করতে আরও শিখবো।তাপহারী বিক্রিয়ায় ঘনমাত্রার প্রভাব
অনান্য রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো তাপহারী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রেও বিক্রিয়কের ঘনমাত্রা বিক্রিয়ার দিক ও হারের উপর প্রভাব ফেলে। ঘনমাত্রা পরিবর্তনের ফলে বিক্রিয়ার দিক ও সাম্যাবস্থা পরিবর্তনও লা-শাতেলীয়ারের নীতি দিয়ে ব্যাখা করা যায়।লা-শাতেলীয়ারের নীতির আলোকে বলা যায়, তাপহারী বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থায় ঘনমাত্রার যেকোনো পরিবর্তন সিস্টেমকে একটি নতুন সাম্যাবস্থায় পৌঁছাতে বাধ্য করে। এক্ষেত্রে সাম্যাবস্থায়-
- বিক্রিয়কের ঘনমাত্রা বাড়ালে বিক্রিয়া উৎপাদের দিকে অগ্রসর হয়। ফলে তাপ শোষণ বৃদ্ধি পায়।
- উৎপাদের ঘনমাত্রা বাড়ালে বিক্রিয়া বিক্রিয়কের দিকে অগ্রসর হয়। অর্থাৎ বিক্রিয়ার দিক পরিবর্তন হবে বিপরীতমুখী বিক্রিয়া (Reverse Reaction) সংঘটিত হবে।
তাপহারী বিক্রিয়ায় লেখচিত্র
নিচে তাপহারী বিক্রিয়ার অগ্রগতি বনাম সিস্টেমের শক্তির একটি গ্রাফ দেখানো হলো -$$ \begin{document} \begin{tikzpicture}[scale=1.2] % Axes \draw[->, thick] (0,1.3) -- (6.6,1.3) node[midway, below] {Progress of Reaction}; \draw[->, thick] (0,1.3) -- (0,7) node[midway, above, rotate=90] {Energy (kJ)}; % Reactant line \draw[thick, blue, line width=2pt] (0,2) -- (2,2) node[midway, below] {Reactant}; % Energy curve \draw[thick, orange, smooth, line width=2pt] (2,2) .. controls (3,6.5) and (4,8) .. (4.5,4.5); % Product line \draw[thick, blue, line width=2pt] (4.5,4.5) -- (6,4.5) node[midway, above] {Product}; % Dashed line for maximum energy level \draw[dashed, thick, black, line width=2pt] (0,6.5) -- (6.5,6.5) node[midway, above] {Transition State}; % Energy change arrow (∆H) \draw[<->, thick, red, line width=2pt] (4.3,2.1) -- (4.3,4.4) node[midway, right] {$\Delta H$}; % Activation energy arrow (E_act) \draw[<->, thick, green, line width=2pt] (3.75,2.1) -- (3.75,6.3) node[midway, left] {$E_{\text{act}}$}; % Dashed line from reactants to x-axis \draw[dashed, thick, gray, line width=2pt] (2,2) -- (4.5,2); % Dashed line from products to x-axis \draw[dashed, thick, gray, line width=2pt] (4,4.5) -- (4.5,4.5); \end{tikzpicture} \end{document} $$
এখানে, আমরা দেখছি যে X-অক্ষে সময়ের সাথে বিক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া ও Y-অক্ষে সিস্টেমের সঞ্চিত শক্তি নির্দেশ করছে। এই গ্রাফে বিক্রিয়ক ও উৎপাদের রেখায়দ্বয় সাম্যাবস্থায় রয়েছে (নীল রঙের রেখা)। লাল রঙের রেখাটি বিক্রিয়ার এনথালপি বা মোট তাপশক্তি শোষণের পরিমাণ নির্দেশ করছে। সবুজ রেখাটি বিক্রিয়ার সক্রিয়ণ শক্তি নির্দেশ করে। এখানে কমলা রেখাটিই মূলত বিক্রিয়া সংঘটনের সময়টি নির্দেশ করে। যখন বিক্রিয়ার সংঘটিত হয় তখন বিক্রিয়কের ভাঙ্গন ঘটে তাই শক্তির প্রয়োজন হয়, ফলে সিস্টেমের মোট শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কমলা রেখার শীর্ষ বিন্দু পর্যন্ত বিক্রিয়কের ভাঙ্গন নির্দেশ করে, যেখানে আমরস কমলা রঙের রেখাটিকে অবস্থান্তর অবস্থার রেখাটি স্পর্শ করেছে। অন্যদিকে শীর্ষ বিন্দু থেকে আবার সিস্টেমের সঞ্চিত তাপশক্তি কমতে দেখা যাচ্ছে। এর কারণ এ পর্যায়ে বিক্রিয়ার উৎপাদ গঠন শুরু হয়ে তথা নতুন রাসায়নিক বন্ধন গঠন হচ্ছে, ফলে সিস্টেমের সঞ্চিত তাপশক্তির পরিমাণ কমতে দেখা যাচ্ছে।
বিক্রিয়ার তাপ নির্ণয়
যেকোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার তাপের পরিমান ক্যালোরিমিতি দিয়ে কিংবা বিক্রিয়ক ও উৎপাদের বন্ধনশক্তি দিয়ে নির্ণয় করা যায়। আমাদের বইয়ে ও পরীক্ষায় সাধারণত বন্ধনশক্তি দিয়েই গাণিতিক সমস্যাগুলো দেখানো তাই আমি এখানে বন্ধনশক্তি দিয়ে কিভাবে বিক্রিয়ার তাপ নির্ণয় করবেন তা দেখাবো। গাণিতিকভাবে- বিক্রিয়ার তাপ, ∆H = বিক্রিয়কের বন্ধনশক্তি - উৎপাদের বন্ধনশক্তি ধরি, $$\(CO_2 + H_2 \to CO + H_2O\) $$ বিক্রিয়ার তাপ নির্ণয় করতে হবে। এখানে বন্ধনশক্তি গুলো,- C=O: 799 kJ/mol
- H-H: 436 kJ/mol
- C≡O: 1072 kJ/mol
- O-H: 463 kJ/mol
→ ∆H = 2034 - 1998 = 36 kJ/mol
যেহেতু এখানে ∆H > 0 বা ধনাত্মক, তাই এটি তাপহারী বিক্রিয়া। এবং বিক্রিয়ার তাপ ৩৬ কিলোজুল/মোল, বা প্রতি মোল বিক্রিয়া সংঘটিত হতে ৩৬ কিলোজুল তাপের প্রয়োজন।
তাপোৎপাদী ও তাপহারী বিক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য
তাপহারী ও তপোৎপাদী বিক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য গুলো ছক আকারে নিচে দেওয়া হলো-তাপহারী বিক্রিয়া | তপোৎপাদী বিক্রিয়া |
---|---|
যে বিক্রিয়ার বিক্রিয়ক সিস্টেমের বাহির থেকে তাপশক্তি শোষণ করে উৎপাদ তৈরি করে | যে বিক্রিয়ার বিক্রিয়ক উৎপাদে পরিণত হওয়ার সময় সিস্টেমের বাহিরে তাপশক্তি নির্গত করে। |
এনথালপির পরিবর্তন ধনাত্মক, ∆H > 0 | এনথালপির পরিবর্তন ঋনাত্মক, ∆H < 0 |
শক্তি তাপ হিসেবে সঞ্চিত হয়। | শক্তি তাপ, আলো, শব্দ, বিদ্যুৎ হিসেবে মুক্ত হতে পারে। |
উদাহরণ: বরফের গলন, বাষ্পীভবন, সালোকসংশ্লেষণ ইত্যাদি। |
উদাহরণ: জ্বালানির দহন, নিউক্লিয়ার ফিশন, লোহার মরিচা ধরা ইত্যাদি। |
উদাহরণ: |
উদাহরণ: |